Advertisement

মানুষের বসতির পাশে কোথাও নিবিড় অরণ্য নাই আজ।


মানুষের বসতির পাশে কোথাও নিবিড় অরণ্য নাই। অরণ্য আছে দূর দেশে,যেখানে পতিত- পক্ক জম্বুফলের গন্ধে গোদাবরী-তীরের বাতাস ভারাক্রান্ত হইয়া উঠে।আরণ্যক সেই কল্পনালোকের বিবরণ। ইহা ভ্রমণবৃত্তান্ত বা ডায়েরি নহে-উপন্যাস।উপরোক্ত অংশটুকু পড়ে যে কারো মনে হতে পারে এটা শুধুই বনজঙ্গল নিয়ে কোন একটি গল্প বা উপন্যাস। আসলেই কি তাই।

কাহিনী সংক্ষেপ

সত্যচরণ সদ্য বি. এ. পাস করা ছেলে। সে উপন্যাসের অন্যতম প্রধান চরিত্র ও বটে। পুরো উপন্যাসটি গড়ে উঠেছে তার জীবনের বনজঙ্গলে কাটানো বেশ কয়েকটা বছর নিয়ে। সত্যচরণ বন্ধুর অনুরোধে এবং নিজের প্রয়োজনেই গহীন অরণ্যের ভীতরে জমিদারি এস্টেটে চাকরি নিয়ে যায়। প্রথম দিকে তার জনবহুল এবং প্রাণচাঞ্চল্য ভরপুর কোলকাতা শহরের কথা মনে হতে থাকে। কিন্তু যতই দিন যায় ততই তার কোলকাতার প্রতি টান কমতে থাকে,বাড়তে থাকে অরণ্যের প্রতি টান। অরণ্যের ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনা তার মনে স্থান গেড়ে নিতে থাকে। অরণ্যের ঘটে যাওয়া ছোট বড় ঘটনা,এখানের মানুষ এবং তাদের জীবনযাত্রা নিয়েই গড়ে উঠেছে উপন্যাসটি।

উপরোক্ত লাইনগুলো পড়লে মনে হতেই পারে এটা শুধু ভ্রমণের গল্প বা এমন কিছু। এটা সত্যচরণের অপরাধ স্বীকার করে মনের ভার লঘু করার গল্প ও বটে। কি সেই অপরাধ আরণ্যক বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের চতুর্থ উপন্যাস। আরণ্যক প্রথম প্রকাশ হয়। তিনি বেশ কয়েকবছর চাকরিসূত্রে ভাগলপুরে পাথুরিয়িঘাটা এস্টেটের সহকারী ম্যানেজার থাকা অবস্থায় ইসমাইলপুর আর আজমাবাদে অরণ্যের সান্নিধ্যে কাটান। অরণ্যের এই পরিবেশ তার মনে দাগ কেটে যায়। প্রকৃতির উপরে তিনি প্রেমেই পড়ে যান। সেই ভালো লাগা থেকেই তিনি লিখে ফেলেন আরণ্যক।

আরণ্যক বইটা পড়বেন অথচ আপনার বনে যেয়ে উপন্যাসের চরিত্রগুলোর মত জীবনযাপন করতে চাবেন না এরকম হতেই পারে না। বিস্তারিত প্রতিক্রিয়া লিখার আগে নিজের কিছু কথা বলি।ঘরে বেড়াতে কার না ভালো লাগে? আমরা সবাই বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে থাকি। অনেকের আবার ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ হয়ে ওঠে না। 


এটা সত্যচরণের অপরাধ

জীবনের কর্ম ব্যস্ততার মাঝে একটু দূরে কোথাও সমুদ্র বা পাহাড় বা বনজঙ্গলে ঘুরে নিজেকে হালকা করতে সবাই পছন্দ করি। আরণ্যক বইটা পড়েছিলাম করোনার সময়ে লকডাউনের ভীতরে।বইটার প্রত্যেকটি পেজ পড়েছি আর মনে হয়েছে আমিও মনে হয় সেই গহীন অরণ্যের ভীতরে হারিয়ে গিয়েছি। কিছু কিছু বই থাকে যেগুলি মনের গভীরে স্থান করে নেয়। আরণ্যক হলো তেমন একটি উপন্যাস।

বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় এর লিখার সাথে প্রথম পরিচিত হই আমি চাঁদের পাহাড় বইটার মাধ্যমে। বইটা পড়ে এত বেশী ভালো লাগে,সাথে সাথেই আরণ্যক বইটি যোগাড় করে ফেলি। চাঁদের পাহাড়ের থেকেও আরণ্যক বইটি মনে বেশী ছাপ ফেলেছে। কেন এই ছাপ ফেলেছে বিস্তারিত আলোচনায় যাই এবার।অরণ্যক বইটি পড়ে প্রথমে মনে হতেই পারে সত্যচরণ বইটির প্রধান চরিত্র। কিন্তু আসলেই কি তাই।

বইয়ের শুরুতেই দেখতে পাই বেকার একজন মানুষের কথা। মেসে ভাড়া দেয়া বাকি, আইন পাশ করেও চাকরি মিলছে না এদিকে মেস ম্যানেজারের তাগাদার পর তাগাদা। ইউনিভার্সিটি জীবনের কষ্টের কথা মনে পরে যায় না? একান্তই নিরূপায় হয়ে সত্যচরণ এই চাকরি গ্রহণ করে। বেচারা সত্যচরণ শহুরে মানুষ, শহরের সমস্ত সুবিধা বাদ দিয়ে থাকা কি তার পক্ষে সম্ভব? বিপদে পড়লে অনেক অসম্ভবই সম্ভব হয় যেমন পেরেছিলো সত্যচরন সেইখানে থাকতে। এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র অরণ্য। এই উপন্যাসের সমস্ত কিছু এই অরণ্য ঘিরেই গড়ে উঠেছে। সত্যচরণ থেকে শুরু করে ছোট বড় প্রত্যেকটি চরিত্র গড়ে ওঠার প্রধান পটভূমি অরণ্য। 

উপন্যাসটির শুরু হয় কোলকাতা শহর থেকে। বিভূতিভূষণ খুব চমৎকারভাবে খুবই অল্প কথায় কোলকাতার কিছু চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন যা পড়ার সময়ে মনে হবে আপনার চোখে ভেসে উঠছে। সত্যচরণের অসহায় অবস্থার সময়টুকু দেশের বেশীরভাগ ছাত্র-ছাত্রী নিজেদের সাথে মিল খুজে পাবে। প্রথম যখন সত্যচরণ কোলকাতা ছেড়ে জঙ্গলে পাড়ি জমান,প্রথম দিকে তার সেখানে মানিয়ে নিতে খুবই কষ্ট হয়। কিছুদিন সেখানে থাকার পর তিনি অরণ্য এবং এখানে বসবাসরত মানুষ আর তাদের জীবনযাপনের যে সহজসরল পদ্ধতি তার প্রেমে পরে যান। 

মানুষ মাত্রই চাহিদার শেষ নেই। এটা পেলে ওটা চায়। সাধারণত শহরের মানুষের চাহিদার শেষ হয় না বললেই হয়। বিভিন্ন চাহিদার বেড়াজালে আটকা এই শহরের মানুষ। কিন্তু সেই গহীন অরণ্যের মানুষের চাহিদা খুব অল্প যা শহরের মানুষ চিন্তাও করতে পারবে না। তারা এতটাই গরীব যে অনেকেই সারাবছর কলাইয়ের ছাতু, মকাইয়ের ছাতু খেয়ে থাকে অনেকেই। ভাত তাদের কাছে মহাভোজএত কম পেয়েও তাদের খুশী দেখে সত্যচরণ যারপরনাই অবাক হয়। এবং তারা যে নিজেদের এই অল্প থেকেও অন্যকে সাহায্য করার জন্য একপায়ে খাড়া তা অরণ্যের এই সহজ সরল মানুষগুলোকে না দেখলে সত্যচরণ বুঝতো না। বিভুতিভূষণে বন্দোপাধ্যায় এর লিখার ধরনই এমন যেন আপনার মনে হবে আপনি নিজেই চরিত্রগুলোর সাথে মিশে গিয়েছেন।

উপন্যাসটিতে অরণ্য প্রধান চরিত্র। লবটুলিয়া এবং তার আশেপাশের অরণ্যের যে শান্তিময় বর্ণনা দেয়া হয়েছে তা শুধু কল্পনাতেই ফুটিয়ে তোলা সম্ভব। এত শান্ত স্নিগ্ধ, মাতাল করা বর্ণনাতে হারিয়ে যেতে চাইলে আপনাকে দোষ দেয়া যাবে না। বিভিন্ন প্রকার বনলতা, গাছপালা, ঘন সবুজ পাতার ফাকে নীল আকাশ, সেখানের হ্রদ স্থানীয় ভাষায় যাকে বলে কুন্ডি তেমন একটা কুন্ডি হলো সরস্বতি কুন্ডি যেখানে স্থানীয়রা মনে করে মায়াবিনী বনদেবীরা জলকেলী করে, বিভিন্ন ফুলের সুবাসের কথা যেভাবে বর্ণনা করেছেন তার তুলনা নেই।

সেইসাথে বনের ভেতরে বিভিন্ন পাখির নামধাম, তাদের কূজন। কখনো তারা একাই ডাকছে, কখনো দলবেঁধে, কখনো মনে হবে গান গাইছে, কখনো তারা ঝগড়াটে মহিলার মত কোমড় বেঁধে ঝগড়া করছে। পাখি নিয়ে এই বর্ণনা আপনাকে একদম বনের ভেতরেই নিয়ে যাবে। অরণ্যের এই বর্ণনা পড়ার সময় নিজের অজান্তেই যে নিজেকে সত্যচরণের জায়গায় কল্পনা করেছি সেটা স্বীকার করতে আমার বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই। 

এরপরে আসি সত্যচরণের কাছে। সাদাসিধে শহুরে আইন পাশ করা ছেলে। শহুরে মানুষ মাত্রই যন্ত্র বিশেষ এই কথাটা সত্যচরণের সাথে যায় না। সহজ সরল সত্যচরণ অন্যের দুঃখে সহজেই দুঃখী হয়। অরণ্যের মধ্যে থেকে তার মন ও হয় নির্মল শান্ত। চেষ্টা করে সবসময়ই গরীব দুঃখিকে সাহায্য করার। তার উপরওয়ালা অখুশি করে হলেও অন্যদের সাহায্য করার যে আপ্রাণ চেষ্টা সেটা আসলেই প্রশংসনীয়। 

যে অরণ্য তার জীবনে দান করেছে একরাশ শান্তি সেই অরণ্য তার হাতেই নষ্ট হওয়ায় প্রচন্ড অপরাধবোধে ভুগতো সত্যচরণ৷ এজন্যেই বইয়ের শেষে লেখক লিখেছিলেন "হে অরণ্যানীর আদিম দেবতারা, ক্ষমা করিও আমায়। বিদায় আমরা জানি না তাকে অরণ্যানীর দেবতারা আসলেই ক্ষমা করেছিলেন কি না।

হয়ত করেছিলেন তিনি বিদায় নিচ্ছেন এটা দেবতারা মেনে নিয়ে হয়তো মাফ করে দিলেও সেখানের মানুষ কিন্তু বিশ্বাস করতে চায়নি তিনি আসলেই লবটুলিয়া থেকে আজীবনের জন্য চলে যেতে পারেন। সুরতিয়ার সাথে শেষ কথপোকথনেই কিন্তু সেটা স্পষ্ট হয়।

ওঁকে আমার চাই

পন্যাসে ছোট ছোট বেশ অনেকগুলো শক্তিশালী চরিত্র রয়েছে। তাদের মাঝে মঞ্চী, রাজু, ধাওতাল সাহু, ধাতুরিয়া, মটুকনাথ পন্ডিত, কুন্তা, যুগলপ্রসাদ, ভানুমতী সহ বেশ কয়েকজন উল্লেখযোগ্য। কথায় আছে স্বর্গেও স্বাপ থাকে, ঠিক তেমনি এসব সহজসরল মানুষের মাঝেও থাকে দুয়েকজন খারাপ মানুষ।

রাসবিহারী সিং আর নন্দলাল ওঝা ঠিক তেমনি দুটি চরিত্র। এই চরিত্রগুলি পড়তে যেয়ে কখনো আপনার হাসি আসবে,কখনো মন খারাপ হবে বা কখনো রাগ অনুভব করবেন। কিছু কিছু লাইন একদম মনের গভীরে গেঁথে যাবে। কিছু বর্ণনা আপনাকে চিন্তায় ফেলে দিবে আপনি বই পড়ছেন নাকি আসলেই লবটুলিয়ায় স্ব শরীরে অবস্থান করছেন।

বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের শব্দচয়ন এতই চমৎকার পড়তে গেলে কখনোই বিরক্তি আসবেনা।আরণ্যক হলো সেই ধরনের উপন্যাস যেটা পড়ার সময় মনে হবে এই বইটা শেষ না হোক। কিন্তু সব ভালো কিছুর মত এই বইটিরও শেষ আছে। শেষ হবার পর মন ভালো এবং খারাপ উভয় অনুভূতিই হবে। সত্যচরণের বিদায়ের সময় রাজু বলেছিলো হুজুর আপনি চলে গেলে লবটুলিয়া উদাস হয়ে যাবে। লবটুলিয়া উদাস হয়েছিলো কিনা আমি জানি না, কিন্তু আমি যে উদাস হয়ে গিয়েছিলাম এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

শেষ করছি অরণ্যের থেকে বিদায় নেয়ার সময় তার সেই আফসোস করা কথাগুলো দিয়ে শোন দিনা দিনের পর দিন সক্রিফাইস করে জীবনটা তেজ পাতা ভাজা হয়ে গিয়েছেএখন থেকেনিজেকে সময় দিব নিজের জন্য বাঁচব নিজেকেই ভালোবাসব।

সাবরিনার কথা শেষ হলে দিনা বলল, এ আবার নতুন কি?যুগে যুগে কিছু মানুষ নিজের সুখের জন্য ভেবে ভেবে দিন পার।এই নিয়ে সাবরিনার ব্যক্তিগত ভাবনা জানতে চাইল দিনা।ভাবছি আজকে অফিস শেষে একটি রেস্তোরাঁয় যেয়ে নিজেকে সময় দিব কফি খেতে খেতে।অবশ্যই।ঐ যে নিজেকে সময় দিন। নিজেকে ভালো রাখতে গেলে নিজের জন্য তো খরচ করা উচিত সামনের বৃহস্পতিবার ঢাকা টু কক্সবাজার দুই দিনের ট্যুর দিব।

এরজন্য একটু শপিং করতে হবে।তুই কি আগামীকাল আমাকে শপিং করতে হেল্প করতে পারবি?আমার সোয়ামি আবার বলে তোর রুচি নাকি আমার চেয়ে সুন্দর।আমি অবশ্য বলি, ঠিক বলেছ । আমি বিয়ে করেছি শিম্পাঞ্জিকে আর দিনা করেছে মানুষকে হাসতে হাসতে বলল, তুই ফোন করে প্রথমে কি বললি

নিজেকে সময় দেয়া উচিত তাহলে আমি কেন তোর জন্য আমরা সময় নষ্ট করব তাও নিজের টাকা খরচ করে সাবরিনা বিরক্ত হয়ে বলল কারণ তুই আমার বান্ধবী আর আমি শপিং করব,তোর টাকা কিভাবে খরচ হবে মার্কেটে যেতে আসতে আমার রিক্সা ভাড়া লাগবে প্রায় একশো টাকা একটু আগেই তো তুই বুঝাইলি নিজের ইনকামের টাকা নিজের জন্য খরচ করা উচিত।

সাবরিনা মনে মনে বলল,আমি তো ঠিকই বলেছি নিজেকে ভালোবাসা উচিত।আর আমার নিজেকে ভালো রাখার জন্য তোর চিন্তা করতে গেলে কি আর ভালো থাকা যাবে। 

সাবরিনাকে দিনা বলল, আমরা বেশিরভাগ মানুষ নিজেকেই বেশি ভালোবাসি। যেমন আমরা কি বলি, আমার বাবা-মা, আমার স্বামী/স্ত্রী আমার সন্তান, আমার বন্ধু ইত্যাদি। যখন পর্যন্ত সবাই আমাকে কেন্দ্রে রাখে, আমরা সুখী। অন্যথায় আমরা দুঃখী পৃথিবীতে কেউ একা থাকতে চায় না। বেশিরভাগ মানুষ চায়,তার মনের মত সব ঘটবে। 

তারচেয়ে মজার কথা বলি,তুই কিন্তু একা একা ঘুরে এসে সেই ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করবি সাবরিনা হাসতে হাসতে বলল, না হলে আমার পেটের ভাতই হজম হবে না। তাহলে আর কিভাবে নিজেকে সময় দিলি। সুন্দর কমেন্ট হলে উত্তর দিতে দিতে সময় আনন্দে কাটানো হয়ে যাবে।

আর যদি কম লাইক এবং নেগেটিভ কমেন্ট পড়ে তাহলে মন খারাপ হয়ে যাবে। পরিবার ছেড়ে একা ঘুরতে যাওয়া, তারপর এসে ফেসবুকিং দিন শেষে পরিবারকে সময় না দিয়ে পরিবারের বাইরের মানুষকে দিলি। তাহলে নিজেকে কিভাবে সময় দিলি সাবরিনা অবাক হয়ে বলল- তাই তো, ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে সেই একই,মানুষ একা বাঁচতে পারে না বই সেটাও তো একজন মানুষের উপলব্ধি।


অন্যথায় আমরা দুঃখী পৃথিবীতে

দিনা মন খারাপ করে বলল সবসময় একা ভালো থাকতে চাওয়া মানেই মানসিক অস্থিরতা বা অসুস্থতার আভাস। কারণ একা কখনোই ভালো থাকা যায় না।কান্নার শব্দ শুনে সৈকত সাহেবের ঘুম ভেঙে গেল। রাত ২ টা। একটানা কেঁদেই চলেছে কংকা। মেয়েটা প্রতি রাতে এমন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে, সহ্য হয় না। কি আশ্চর্য একটি মেয়ে যে আল্লাহ তাকে দিয়েছেন।

তিনি তার স্ত্রীর দিকে তাকালেন। নীলার ঘুম কিন্তু ভাঙেনি। বরং গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। মেয়ের কান্নার আওয়াজ কি সে শুনতে পাচ্ছে না? তিনি একবার ভাবলেন, নীলাকে ডেকে বলবেন, দেখো তোমার মেয়ে কেমন করে কাঁদছে। কিন্তু বললেন না। ঘুম থেকে জাগিয়ে দিলে নীলা এমনভাবে তাকায় যেন তিনি ভয়াবহ এক সাইকোপ্যাথ, হাতে ছুরি নিয়ে নীলার দিকে তাকিয়ে আছে।

তিনি বিছানা থেকে নেমে বারান্দায় এসে দাড়ালেন। সিগারেট ধরিয়ে তাকালেন বাইরের বাগানে। ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে। ঠান্ডা বাতাসে চমৎকার হাস্নাহেনার ঘ্রাণ। ওনার খুব প্রিয় ফুল। কিন্তু সাপ আসে শুনে ইদানীং ভাবছেন গাছটি কেটে ফেলবেন কি না। না গাছ কাটা যাবেনা। কংকা এতো পছন্দ করে। কেটে ফেললে ভীষণ কষ্ট পাবে। হয়তো বাবার সঙ্গে কথাই বলাই বন্ধ করে দেবে। মেয়ের যা রাগ, একবার জেদ ধরলে তাকে সামলানো মহা মুশকিল। 

কংকা একবার বলেছিল, বাবা সিন্ডারেলার ছবিওয়ালা খাতা এনো। তিনি বললেন, আনবো। কিন্তু খাতা আনতে ভুলে গেলেন। কংকার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে নরম গলায় বললেন, কাল অবশ্যই আনব। প্রমিজ। ঠিক আছে। মনে থাকে যেন। প্রমিজ করেছো কিন্তু।মনে থাকবে।

কিন্তু মনে থাকল না। খাতা এনেছিলেন ঠিকই, কিন্তু সিন্ডেরেলার ছবি ছিল না। স্পাইডার ম্যানের ছবি ছিলো। কংকা প্রথমে কেঁদে পুরো বাড়ি মাথায় তুললো। তারপর জেদ ধরল সে দরজা বন্ধ করে ঘরে বসে থাকবে। এক পর্যায়ে সত্যি সত্যিই তার রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিল।

সৈকত সাহেবেরও মেজাজ খারাপ হল। বাচ্চা একটি মেয়ে তার এত কিসের জেদ তারা তো এমন ছিলেন না। বাবার সাথে এভাবে রাগ দেখানো দূরে থাক, বাবার সামনে দাঁড়ালেই ভয়ে তাদের হাঁটু কাঁপত। এখনকার বাচ্চাগুলো নিয়ন্ত্রণের এমন বাইরে চলে যাচ্ছে কেন কে জানে। ভাবলেন থাকুক রুমের ভিতর বন্দী হয়ে।

এভাবে কয়েক ঘন্টা পার হয়ে গেল, মেয়ে আর দরজা খুলে না। ততক্ষণে তিনি আর তার স্ত্রী আতংকে অস্থির। ডাকাডাকি চিৎকার, কোনকিছুতেই সাড়া দিচ্ছে না। শেষে তালা ভেঙে ভিতরে ঢুকে দেখে, মেয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে। কেঁদে চোখমুখ ফুলিয়ে ফেলেছে। তিনি যথাসম্ভব স্বাভাবিক গলায় বললেন, এত ডাকছি, সাড়া দিচ্ছিস না কেন। 

কংকা তাকে অবাক করে দিয়ে চেঁচিয়ে বলল, যখন দরজা বন্ধ করেছি তখন কেন ডাকোনি সিগারেট মেঝেতে ফেলে স্যান্ডেল দিয়ে পিষে নিভিয়ে ফেললেন ফিল্টারের লাল আগুন। মেয়েটি এখনো কাঁদছে। তিনি ভাবলেন, চেষ্টা করে দেখা যাক মেয়েটিকে বুঝিয়ে সুজিয়ে শান্ত করা যায় কি না।

দরজা খুলে বাইরে বেরুলেন। বাগানের যেখানে দোলনা ঝুলানো থাকতো, সেখানেই কংকার বাঁধানো কবর। জায়গাটি খুব পছন্দ করতো কংকা। যখন ওর ক্যান্সার ধরা পড়ল, সে এখানেই বসে কাটিয়ে দিতো অধিকাংশ সময়। এমনকি রাতেও বসে থাকতো। অনেক রাত হয়ে গেলে এক সময় সৈকত সাহেব কোলে করে মেয়েকে নিয়ে আসতেন ঘরে। তখন দুজনের চোখেই পানি থাকতো। 

নিতুর সাথে আমার প্রেম ছিল, চিঠির মতো। কাগজ আর কলমে আঁকা দারুণ মায়ার চিঠি প্রেম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় অনার্স করে শখ হলো গ্রামে থাকার। গ্রামের সরলতায় মিশে যাওয়ার। করলামও তাই। আমি জানতাম না, এর বিনিময়ে কি চমৎকার অনুভূতি অপেক্ষা করছিল। 

গ্রামের সহজ-সরল মানুষগুলোর কাছে তখন আমি অনেক বিশাল কিছু। কিছুদিন যেতে আমি গ্রামে একটা পাঠশালা খুললাম। সেখানে গ্রামের বাচ্চাকাচ্চারা স্ব-আনন্দে পদার্পণ করতে লাগলো। গ্রামের সহজ-সরল মানুষগুলোর কাছে বেশ সমিহ করার মতো পাত্র হিসেবে গড়ে উঠলাম অল্প দিনেই। 

তখন চিঠির যুগ। কাগজ, কলম আর মানুষের আবেগ একই সুতোয় বাধা।খুব জানতা মানুষ ভাবতো বলেই বোধহয় গ্রামের কিছু মানুষ আমার কাছে চিঠি লিখতে এবং পড়াতে আনতো। আমিও কাজটা উপভোগ করতাম। লিখতে যতটা না ভালোবাসতাম, তার থেকে বেশি ভালোবাসতাম পড়তে। কি নিদারুণ আকুতি, টান আর ভালোবাসায় ঘেরা এক একটা চিঠি! একটা সময় এসে কাজটা আমার শখে পরিনত হয়ে গেল। আমি স্বাচ্ছন্দ্যে চিঠি শিল্পি হলাম। 

মানুষের ভেতর পড়া মন পড়া যে এত আনন্দ, প্রকাশ করা অসম্ভব। এমনই চলছিল দিন। একদিন পরন্ত বিকেলের চমৎকার সৌন্দর্যে খালের পারে বসে আছি। জোয়ারের স্রোতে খালের পানি টইটম্বুর। পানির স্রোত ঘাস ছুঁয়ে যায় পা ছুঁয়ে যায়, ছুঁয়ে যায় আমার মন।


ভালোবাসতাম, তার থেকে বেশি 

ওই পড়ন্ত বিকেলে খুব ধীরেসুস্থে কেউ একজন এসে আমার ঠিক ডান আশে বসলো। আমি পাশে তাকাতেই খানিক চমকে উঠলাম। লাল হলুদের সংমিশ্রণে একটা শাড়ি পরিহিতা সেই তরুনীটাকে আমার একটা মিষ্টি হলদে পাখি বোধ হলো। 

আমার দিকে একটা খাম এগিয়ে দিয়ে বলল এই চিটিডা ইট্টু পইড়ে শোনাইবেন, মাস্টার আমার মনে হলো বহুজন বহুবার এই একই কথা বলেছে, কিন্তু এমন করে কেউ কক্ষনও বলেনি, কেউ না আমি বললাম হুম শুনাবো। কই দেখি চিঠিটা বলেই চিঠিটা তার থেকে নিলাম। ঢাকা থেকে তার এক খালার পাঠানো চিঠি। 

এরপর প্রায়শই নিতু আমার কাছে চিঠি নিয়ে আসতো। অল্পস্বল্প কথা হতো। টুকটুক করে কথা বলতো। আমার ওকে নাম দিতে ইচ্ছে হলো, প্রিয়দর্শিনী একটা মানুষ, একটা মেয়ে, অবিচল বিচরণ করে বেরাতে লাগল, আমার জাগতিক চিন্তায়। মন অস্থির হয়ে উঠছিল ক্রমশ। এক দেখাতে মন হারালাম কারো কাছে, ভেবেই কেমন বিস্মিত হই। 

একদিন সারা রাত ভেবে ভেবে খুব ছোট্ট একটা চিঠি লিখে কাটিয়ে দিলাম! অনুভূতি বপন করা এত কঠিন, আগে জানা ছিল না। পরদিন সে যখন এলো, চিঠিটা তখন আমার বুকপকেটে খুব গোপনে আগলে রাখা যেমন করে আগলে রাখি তাকে ঘেরা অনুভূতি। 

ততোদিনে আমাদের সম্বোধন তুমিতে এসে ঠেকেছে।আমি বললাম যাব। আমরা জারুল তলায় বসলাম। একটা জারুল ফুল ছিড়ে মেয়েটা তার বেনীতে গাঁথল এতো মনোরম হয়, বেনীতে গাঁথা জারুল আমি জারুলের প্রেমে পড়লাম এবং তাঁর; বারবার, বারংবার নিতু বলল, "আচ্ছা বলো তো মাস্টার, ফুল সুন্দর নাকি মানুষ।

আমি বললাম, তুমি ও ঠিক বুঝলো না বোকা মেয়ে একটা বললাম তোমার একটা চিঠি আমার কাছে আছে, নিবা না  আমার চিঠি তোমার কাছে? কেমনে? কই দেখি আমি চিঠিটা বুকপকেট থেকে বের করে ওর হাতে দিলাম। ও কিছুক্ষণ নেড়েচেরে বিস্ময় নিয়ে বলল। 

আমি একবার ওর দিকে তাকালাম, ল্যাপ্টানো কাজল চোখে, ভ্রুর পাশের কালো তিলটায়, আর ফুলের মতো মুখটায়! আমার হৃদস্পন্দন কি ভয়ানক ভাবে বেড়ে গেল। নিশ্বাস আটকে মরে যাওয়ার মতো রুদ্ধশ্বাস অনুভূতি ইশশ, প্রেমে পড়া এত কঠিন আমি পড়তে আরম্ভ করলাম। 

প্রিয়দর্শিন

রুদ্ধশ্বাস মায়া বোঝ দীঘির জলের ছাঁয়া মায়া জরানো কায়া বোঝ তোমায় দেখি, মায়া দেখি, চোখের জ্বালা দেখ? মন পুঁড়ে যায়, প্রাণ পুঁড়ে যায়, বলো তুমি; বোঝ নদীর পারে তোমার পায়েল, আওয়াজ তোলে কেন? সে কি জানে, একটা মানুষ, কেমন করে; মরেবাঁচে যেন। এরপরে আর অমন করে চুল বেঁধো না, চোখে ধাঁধিয়ে যায় আর দিও না, অমন কাজল, লেপ্টে যখন যায়!

আর পড়ো না অমন পায়েল, খুলেই যখন যায়।আর হইয়ো অমন মায়ার, মন হারিয়ে আমি চিঠি বন্ধ করে ওর দিকে চাইলাম, ও চেয়ে আছে, উদাস হয়ে। করুন হয়ে আমায় কইল, এত কঠিন ভাষাও মাস্টার আমি তো কিছু বুঝি নাই। কিন্তু কেমন যেনআপন আপন কে দিছে এই চিঠিখানা? আমায় একটু বুঝায়ে দিবা

আমি বললাম আমায় বোঝোআমার কথাও বলল,বুঝি তো আমি বললাম, তবেই হবে। এখন চলো। আমার চিঠির প্রেম ওখানে শুরু। এরপর যখন যখন ইচ্ছে হতো, তখন তখন লিখতাম। কখনো বা না লিখেই মুখে বলতাম, ও ভাবতো কাগজ দেখে বলছি, আসলে তো না নয়। আমি ওঁকে পড়ি, ভাঙি গড়ি।

আমি জানি না ও বুঝে গিয়েছিল কিনা৷ কিন্তু এরপর আর কখনো জানতে চায়নি, কে লিখে এই চিঠি সেবার একটা কাজে ঢাকা গিয়ে আমায় অনেকদিন থাকতে হলো। প্রায় মাসখানেক! নিতুকে না বলেই, হুট করে যেত হলো। নিতুর প্রতি আমার কঠিন প্রেমের এক দারুন উপলব্ধির সময় ছিল তা। কাছে না থেকেও, কথা না বলেও, প্রতিমুহূর্তে কেমন করে মনের খুব নিকটে রাখা যায়, তা বুঝেছিলাম।

গ্রামে ফিরলাম যেদিন, সেদিনই ও আমার কাছে ছুটে এলো। আসমান থেকে নেমে আসা পরী মনে হলো। একজন দুঃখী পরী! ক্লান্ত, অসহায়, নির্জিব মুখের সেই মেয়েটা সেদিন জানান দিল, তার মনে আমার স্থান।

আমায় বলল আমায় একটা চিঠি লেইখা দিবা আজ আমি সুধালামআগে কও কেমন আছো মেয়েটা বলল, "ভালো নাই। একটুও ভালো নাই মাস্টার তুমি অত দূরে আর যাইও না। দিবা কও লেইখা একটা চিঠিদিব তো কার কাছে। 

ও বলল তাঁর কাছে কী লিখবো, কও আমরা সেই জারুলের নিচে গেলাম। যেখানে আমাদের চিঠি প্রেমের শুরু বসলাম আমি, বসলো সেও। চোখের পাশে উড়ে আসা অগোছালো, ছন্নছাড়া চুল গুলো সরাতেই হাতের চুরি ঝুমঝুমিয়ে নিচে নেমে এলো। গাছের সাথে হেলান দিয়ে; আমার দেয়া চুরি খুললো, নূপুর খুলল, টিপ খুললো, চোখের কাজল মুছে নিল, চুল গুলো সব খুলে নিল। আমি দেখি, মরি! সেই মেয়েটা ছন্দের মতো কইতে লাগলো। তাঁরে তুমি বইলা দিও, দেই না তো তাঁরে ব্যাথা,

আমার জনম সুখ তারে দেই, বিনিময়ে চাই কথাক্যান হারাইলো, ক্যান পালাইলো দিয়ে এমন ব্যাথা তারে তুমি বইলা দিও, আমার মনের কথা বিনিময়ে কিচ্ছু চাই না, চাই শুধু তার কথা।


বুকপকেটে খুব গোপনে 

চুরি চাই না, নূপুর চাই না, যাইমু নির্বাসনে তাঁরে যদি না পাই মনে, না পাই গো মোর সনে শুনলা মাস্টার? তারে তুমি কইয়া দিও, আমার সকল কথা সে যেন আর না ছাইড়ে যায়, না দেয় মোরে ব্যথা। এর পরের শুক্রবার আমাদের বিয়ে হলো। আমার হুট করেই মনে হয়েছিল, ওঁকে আমার লাগবেই, ওঁকে আমার চাই

আমার প্রিয়দর্শিনী! সেই প্রথম দিনের মতো, সুন্দর, স্বচ্ছ, কোমল। আমি তাঁরে কইলাম আর কখনো অমন করে কাঁদবা না। দহন দেখ মনের দহন দেখ না, না আর কখনো অমন করে কাঁদবা না। আমার ফুল, আমার পরী, আমার প্রিয়দর্শিনী আমার নিষেধ অমান্য করে সেদিনও কাঁদল।

বুকের মধ্যিখানে মাথা রেখে কইল আগে কও আমায় রেখে, একলা করে, অমন করে আর যাইবা না আগে কও? আমায় তুমি কাগজে কথা কওয়া কোনোদিনও থামাইবা না। আমি তারে কথা দিলাম, তার কথা অক্ষরে অক্ষরে মান্য করলাম। 

রোজ রাতে তার মান ভাঙাতে আস্ত একটা চিঠি লিখতাম, কিংবা লিখতাম প্রেম, চিঠির প্রেম। আমি তারে পড়ে শোনাই, সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে এরপরে তো আমার ঘরে ছেলে এলো, মেয়ে এলো আমার বউটা কুড়ি থেকে বুড়ি হলো। চিঠির প্রেম কেন যেন, কোনোদিনও পুরোনো হলো না! আমি আজও প্রেমে পড়ি, নতুন রঙে, নতুন ঢঙে।

সৈকত সাহেব কবরের পাশে দাঁড়ালেন। শরীরকে যথাসম্ভব বাঁকিয়ে কবরের উঁচু মাটিতে হাত বুলালেন পরম মমতায়। শান্ত গলায় বললেন, মা'রে তুই এত কাঁদিস কেন? আমি ঘুমুতে পারিনা। বাবাকে ভালবাসিস না? রাতে ঘুম না হলে অফিসে কিভাবে যাবো বল। তারউপর আমার অফিসেও চলে যাচ্ছিস। 


সৈকত সাহেব ভাবলেন, মেয়েকে অফিসে যেতে মানা করতে হবে। কংকার সাথে অফিসে কথা বললে, সবাই এমনভাবে তাকায় যেন তিনি রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে নেংটা হয়ে ট্রাফিক কন্ট্রোল করছেন। শান্তিতে মেয়ের সাথে কথা বলারও উপায় নেই। কলিগদের দোষ দিয়ে গিয়ে লাভ? তার স্ত্রীও তো তার দিকে আজকাল কেমন অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে থাকে।