নিন্দ্য আনুষ্ঠানিক বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে নীলাদের বাড়িতে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু সেই সুযোগ হয়নি। নীলার পরিবার সাফ জানিয়ে দিয়েছে যে তারা তাদের মেয়েকে অনিন্দ্যের সাথে বিয়ে দেবে না। নলা যখন তার পরিবারকে এই কেলেঙ্কারির কথা জানায়, তারা প্রথমেই জানতে চেয়েছিল কি হচ্ছে ছেলে"অনিন্দ্যর কিছু বলার ছিল না।
সে কবিতা লিখতো আর একটা পত্রিকা অফিসে অস্থায়ী চাকরি করতো। যদিও কিছুদিন পর সে চাকরি স্থায়ী হয়েছিলো। কিন্তু নীলার বিয়ের জন্য তখন এক ইঞ্জিনিয়ার ছেলের পরিবার থেকে বিয়ের প্রস্তাব এসেছিলো। ইঞ্জিনিয়ার ছেলে রেখে একজন তরুণ কবির কাছে তারা মেয়েকে বিয়ে দিতে রাজি হলো না। এবং পরিবারের সবাই নীলাকে স্পষ্ট জানিয়ে দিলো অনিন্দ্যর নামও যেনো সে আর কখনো উচ্চারণ না করে।
পরদিন নীলা সকালের দিকে অনিন্দ্যর অফিসে এলো। এই প্রথম সে অনিন্দ্যর অফিসে এলো। এসে কোনো প্রকার ভনিতা না করে সরাসরি বললো,"আজই আমরা বিয়ে করবো। তোমার কোনো আপত্তি আছে নীলার দিকে তাকিয়ে বুঝলো নীলা বেশ উত্তেজিত। সে শান্ত গলায় বললো,"এসো অফিস ক্যান্টিনে যাই। ওখানে এখন নিরিবিলি আছে। সব কথা ওখানে হবে।
অনিডাইনিং রুমের জানালার কাছে টেবিলে দুজন লোক একে অপরের বিপরীতে বসে আছে। অনিন্দ্য কফি আর কিছু খাবারের অর্ডার দিল। তারা টেবিলের উপর অস্পৃশ্য শুয়ে আছে. তাদের কেউ মোটেই পাত্তা দেয় না।ন্দ্যর চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,"কিছু বলছো না যে টেবিলের ওপর দৃষ্টি রেখে বললো,"এভাবে বিয়ে করাটা ঠিক হবে না।" অধৈর্য হয়ে বললো,"কীভাবে বিয়ে করাটা ঠিক হবে? ঐ ইঞ্জিনিয়ারের সাথে বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর।
নীলা তোমাকে ভালোবেসেছি তোমার কিংবা তোমার পরিবারের ওপর কালিমা লেপন করার জন্য নয়। পালিয়ে বিয়ে তো করতে পারি। কিন্তু তারপর সবাই তোমাকে নিয়ে তোমার পরিবারকে নিয়ে কুৎসা রটাবে। তোমার পরিবার আত্মীয়স্বজন তোমার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করবে। এসব কোনো ভাবে তোমার জন্য সুখের হবে না। তুমি এখন ঘোরের মধ্যে আছো। যদি এ অবস্থায় আমাকে বিয়ে করো তাহলে যখন ঘোর কেটে যাবে তখন প্রচণ্ড মানসিক যন্ত্রণায় ভুগবে। নিজেকে ভীষণ একা মনে হবে। আমিও পারবো না সে ভয়ংকর একাকিত্ব ঘোচাতে।
করে লেকচার বন্ধ করো। আমি আমার সবকিছু ফেলে এক কাপড়ে তোমার কাছে ছুটে এসেছি আর তুমি আমাকে লেকচার শোনাচ্ছো অনিন্দ্য নীলার হাত ধরে বললো হও নীলা। আমি তোমার মনের অবস্থা বুঝতে পারছি। এটাও বুঝতে পারছি আজ যদি তোমার পরিবার আত্মীয়স্বজন সবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে তোমাকে বিয়ে করি তবে তোমার উপকার নয়, তোমার সবচেয়ে বড়ো ক্ষতি করবো।"নীলা টান দিয়ে হাত সরিয়ে নিলো। আবেগের প্রাবল্যে তার চোখে পানি চলে এসেছিলো।
সে হাত দিয়ে চোখের কোণ দুটো মুছে বললো,"এতো নাটক কেনো করছো? সরাসরি বললেই তো পারো পাঁচ বছর প্রেমের পর এখন আমাকে তোমার আর ভালো লাগছে না। একই মুখ আর কতো ভালো লাগে তাই না? তুমি তো আবার কবি। কবিদের তো নিত্য অনুপ্রেরণা চাই। দিনের পর দিন একই চোখ দেখে কী আর অনুপ্রেরণা আসে? নইলে অমর কবিতা সৃষ্টি হবে কেমন করে! আমাকে নিয়ে যা লেখার তাতো লেখা হয়ে গেছে। তাই বলে কবি সাহেবের লেখা তো থেমে যেতে পারে না। তাহলে যে সাহিত্যের মহাক্ষতি হয়ে যাবে। কবির এখন নতুন নারী চাই। তবেই যে তিনি সৃষ্টি করতে পারবেন অবিনশ্বর কাব্য।
নীলা শান্ত হও। আমি কেবল তোমার ভালোর জন্যই তোমার পরিবারের অমতে বিয়ে করতে চাইছি না। অন্য কোনো কারণে নয়।থামো তুমি। আমার বোঝা হয়ে গেছে তুমি কেমন ভালো চাও আমার। কী করে যে এতো বড়ো ভুল করলাম! কেনো যে তোমাকে আগে চিনতে পারি নি! তাহলে আজ আর এতো কষ্ট পেতো হতো না। আসলে এতোদিন আমি ঘোরের মধ্যে ছিলাম। আজ আমার ঘোর কেটেছে।
তারপর অনিন্দ্যর বুকের শার্টের অংশটুকু হাত দিয়ে খামচে ধরে নীলা দাঁতে দাঁত চেপে বললো,"তুই আমাকে কোনোদিন ভালোবাসিস নি। কোনোদিন ভালোবাসিস নি। কোনোদিন ভালোবাসিস নি। বলেই শব্দ করে চেয়ার পেছনে সরিয়ে উঠে দাঁড়ালো নীলা। এরপর ভেজা চোখ মুছতে মুছতে দ্রুত পায়ে হেঁটে চলে গেলো।মাথা নিচু করে নিশ্চুপ বসে রইলো। তার বুকের দিকের শার্ট কুঁচকে আছে। পরিপাটি ছেলে অনিন্দ্য সে অংশটুকু পরিপাটি করার কোনো প্রয়োজন বোধ করলো না।
এরপর কেটে গেলো পঁচিশ বছর। তাদের আর দেখা হয় নি। তারপর এক শ্রাবণ বিকেলে ব্যস্ত শহরের ফুটপাতে তাদের আচমকা দেখা হয়ে গেলো। দু'জনের শরীরেই বয়সের ছাপ পড়েছে। চুলে পাক ধরেছে, মুখে পড়েছে বলি রেখা, দেহে জমেছে বাড়তি মেদ। তবু এক দেখাতেই কেউ কাউকে চিনতে অসুবিধে হলো না। নীলা প্রাইভেট কার থেকে নেমে ফুটপাতে পা দিতেই তাদের দেখা হয়ে গেলো। প্রাথমিক স্তব্ধতা কাটার পর দু'জনই অল্প হাসলো।
কিছু সময় নির্বাক রইলো দু'জন। এক আকাশ কথা জমে আছে তাদের বুকের ভেতর তবু যেনো কথা খুঁজে পাচ্ছে না তারা। শঙ্কিত কণ্ঠে অনিন্দ্য বললো,"কী হয়েছে তোমার নীলা হালকা স্বরে বললো,"তেমন কিছু না। চেক আপের জন্য এসেছি। বয়স হচ্ছে বুঝতেই তো পারছো। স্মিত মুখে সায় দিলো। নীলা বললো,"এই বইমেলায় তোমার যে বইটি বেরিয়েছে সেটা তুমি উৎসর্গ করেছো নীলা নামের একজনকে। শুধু এটা নয়, আরো একাধিক বই তুমি উৎসর্গ করেছো নীলাকে। কে এই নীলা অনিন্দ্য চুপ রইলো।নীলা বলে যেতে লাগলো,"তোমার প্রত্যেকটি কাব্যগ্রন্থের প্রথম এবং শেষ কবিতাটি থাকে নীলাকে নিয়ে। কেনো জবাবে অনিন্দ্য বললো,"তুমি এখনো আমার কবিতা পড়ো নীলা বুঝলো অনিন্দ্য উত্তর দিতে চাইছে না।
সে বললো,"তোমার সবগুলো বই আমার সংগ্রহে আছে। নীলা আরো কিছু বলার আগেই অনিন্দ্য বললো,"তোমার স্বামী ছেলেমেয়েরা কেমন আছে তারা সবাই ভালো আছে। ছেলেটা লন্ডনে পড়ছে। মেয়েটা এবার কলেজে ভর্তি হবে। বাহ খুব ভালো কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর নীলা বললো,"তোমার বইয়ের কবি পরিচিতিতে কখনো তোমার পরিবারের কথা উল্লেখ থাকে না। তাই তাদের খবরও জানতে পারি না। তোমার স্ত্রী ছেলেমেয়েরা কেমন আছে? বউটা নিশ্চয়ই অনেক সুন্দরী। তুমি তো কবি মানুষ অল্প স্বল্প সুন্দর তো তোমার চোখে লাগবে না।শেষ কথাটায় কিছুটা খোঁচা ছিলো।
নীলা পলক ফেলতে ভুলে গেলো। অপলক তাকিয়ে রইলো অনিন্দ্যর চোখের দিকে। তারপর গলায় চরম বিস্ময় নিয়ে বললো কিন্তু কেনো অনিন্দ্য জবাবে বললো,"হঠাৎ করে আকাশটা কেমন অন্ধকার হয়ে গেলো দেখেছো নীলা বুঝলো অনিন্দ্য উত্তর দিতে চাইছে না।সে বললো শ্রাবণ মাস তো তাই।
কথা শেষ করার আগেই হুড়মুড় করে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি পড়তে শুরু করলো। নীলা ডাক্তারের চেম্বারের শেডের নিচে গিয়ে দাঁড়ালো। ফুটপাতে কিংবা রাস্তায় যে যেখানে ছিলো সবাই হুড়োহুড়ি করে বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য আশ্রয় খুঁজে নিলো। অকস্মাৎ পুরো ফুটপাত ফাঁকা হয়ে গেলো। শুধু একা অনিন্দ্য ফুটপাতের ওপর দাঁড়িয়ে থাকলো।
শেডের নিচ থেকে নীলা চেঁচিয়ে বললো,"বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে আছো কেনো? এই বয়সে বৃষ্টিতে ভিজলে অসুখ করবে। এখানে এসে দাঁড়াও হেসে বলল আজ একটু কাজ ছিলো। আবার কখনো দেখা হবে। ভালো থেকো নীলা।দু'কদম এগুনোর পর একটু থেমে ঘাড় ফিরিয়ে নীলার দিকে তাকিয়ে বললো,"তুমি কি ভুলে গেলে তুমি যে বৃষ্টি ভালোবাসো তারপর আর কিছু না বলে একবারো পেছনে না ফিরে সে প্রবল বৃষ্টির মধ্যে হেঁটে যেতে লাগলো।
শেডের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা নীলা তখন সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেলো। কেনো অনিন্দ্যর প্রত্যেকটি বইয়ের প্রথম এবং শেষের কবিতা নীলাকে নিয়ে? কেনো সে বই উৎসর্গ করে নীলা নামের কাউকে? কেনো অনিন্দ্য সচ্ছল হওয়ার পরও বিয়ে করলো না নীলার তখন মনে পড়লো পঁচিশ বছর আগের তাদের দেখা হওয়ার শেষ দিনটির কথা। চরম উত্তেজিত হয়ে সে অনিন্দ্যর বুকের দিককার শার্ট খামচে ধরে বলেছিলো তুই আমাকে কোনোদিন ভালোবাসিস নি। কোনোদিন ভালোবাসিস নি। কোনোদিন ভালোবাসিস নি।
শূন্য ফুটপাত দিয়ে পক্ক কেশ, মুখে বলি রেখা পড়া, বাড়তি মেদের দেহ নিয়ে ঝুম বৃষ্টিতে দৃপ্ত পায়ে হেঁটে যাওয়া অনিন্দ্যকে দেখে মনে হচ্ছিলো, কোনো বয়সী মানুষ নয়, যেনো সদ্য প্রেমে পড়া কোনো টগবগে যুবক এক পৃথিবী ভালোবাসা বুকে নিয়ে রাজার মতো হেঁটে যাচ্ছে।নীলা মুগ্ধ চোখে সেদিকে তাকিয়ে থেকে মনে মনে বললো,"আমি সেদিন ভুল বলেছিলাম। আমি আমার কথা তুলে নিলাম অনিন্দ্য। তুলে নিলাম।
আমার বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে মা'কে কোনোদিনও ঈদে নতুন শাড়ি পরতে দেখিনি। বাবা ছোটোখাটো ব্যাবসা করতেন। আমি তখন পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ি ঈদের দশ-বারো দিন বাকি থাকতে বাবা আমাকে আর ছোটো বোন মিতুকে একহাজার করে টাকা দিলেন জামা কিনতে, আর মায়ের হাতে দিলেন পাঁচশো টাকা। মা সে টাকা কিছুতেই নেবে না। করুণ মুখে বাবাকে বলল, আমার শাড়ি লাগবে না আলমারিতে অনেক গুলো শাড়ি আছে, না পরে পরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ওগুলো পরা শেষ হলে তারপর নতুন শাড়ি কিনব তুমি বরং ঐ টাকা দিয়ে একটা সার্ট কেনো।
বাবা আঁতকে উঠে বললেন, আমার যে সার্ট আছে তাই পরে শেষ করতে পারি না,নতুন সার্টের কোন দরকার নেই।কথা শুনে আমি আর মিতু ঠোঁট টিপে হাসি। দাদাজানের আমলের একটা পুরনো আলমারি আছে তাতে সর্বসাকুল্যে মার পাঁচ থেকে ছয়খানা শাড়ি আছে আর বাবার আলমারিতে কোন সার্ট নেই। তিনটি সার্ট সবসময় পরে।
বাবার জোরাজুরির কাছে হার মেনে মাকে পাঁচশো টাকা নিতে হলো।আমি, মিতু আর মা ঈদের জামা কিনতে বাজারে গেলাম। বাজারে ঢুকেই মা প্রথমে বাবার জন্য একটা সার্টের পিস কিনলো তারপর কুড়ি টাকা দিয়ে একটা সুন্দর রংয়ের লিপস্টিক কিনলো, মায়ের লিপস্টিক খুব পছন্দ। মা বাকি টাকা আমার আর মিতুকে দিয়ে বলল, মাগো জামা একটু কম দামে নিয়ে, একজোড়া নতুন জুতো কেনো।
ঈদের দিন বাবা নামাজ পড়ে ফেরার আগেই মা কসকো সাবান দিয়ে গোসল করে পুরনো শাড়ি ইস্ত্রি করে পরে, মুখে হালকা করে পাউডার আর চোখে কাজল দিলো আর ঠোঁটে দিলো নতুন লিপস্টিক। অল্প সাজে মা'কে যে কি সুন্দর লাগছে বাবা নামাজ পড়ে ফেরার সাথে সাথে মা টুক করে বাবার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে লাজুক হেসে বলল, দেখো তো রিতুর বাবা আমাকে কেমন লাগছে বাবা অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,ও আল্লাহ এতো একদম পরী! ও রিতু এই পরী কি ভুল করে আমাদের বাড়ি চলে এসেছে লজ্জায় গোলাপি হয়ে বলল, মেয়েদের সামনে কি যে বলো!
মায়ের বিয়ের সতেরো বছর পর মা ঈদে নতুন শাড়ি পরে। আমি তখন নবম শ্রেণীতে পড়ি।আমাদের এক আত্মীয় খুব বড়োলোক ঢাকায় থাকেন উনি ঈদে লোক মারফত আমাদের জন্য জামা মায়ের জন্য শাড়ি আর বাবার জন্য সার্ট পাঠিয়ে দিয়েছেন । শাড়ি হাতে নিয়ে মা'র চোখ খুশিতে চকচক করছে, শাড়ি উল্টেপাল্টে দেখতে দেখতে মায়ের মুখ কালো হয়ে গেল।আমরা দুবোন কিছুই বুঝলাম না। কাজ থেকে বাড়ি ফিরে নতুন কাপড়গুলো দেখতে দেখতে বাবার চোখ ছলছল করে উঠল, আমাকে ডেকে পকেট থেকে পাঁচশো টাকা আমার হাতে দিয়ে বললেন, রিতু তোর মা'কে নিয়ে এক্ষুণি বাজারে যেয়ে একটা নতুন শাড়ি কিনে আনবি।
বাবা রেগে উঠে বললেন, একদম চুপ। ঈদে শাড়ি না কিনে নিজের পুরনো শাড়ি পরে খুশি মনে ঈদ করো আমি মেনে নিয়েছি তাই বলে আত্মীয়ের দেওয়া পুরনো শাড়ি পরে ঈদ করবা সেটা আমি কিছুতেই মেনে নেবো না।
আমি আর মিতু অবাক! আত্নীয় মা'কে পুরনো শাড়ি দিয়েছে! আমরা দুইবোন মা কে সাথে নিয়ে শাড়ির দোকানে যেয়ে সাড়ে চারশো টাকা দিয়ে হালকা নীল রংয়ের পাড় বান্ধানো টাঙ্গাইল শাড়ি কিনলাম। বাবা মুগ্ধ গলায় বললেন, ও রিতু মিতু তোর মা তো দেখি একদম নীল পরী। মনে হচ্ছে এক্ষুণি পিঠে দুটো ডানা গজাবে আর তোর মা আকাশে উড়ে বেড়াবে! এরপর থেকে মা প্রতি ঈদে নীল শাড়িটাই পরবে।আমরা দুবোন বুঝতাম, মা'র নতুন শাড়ি খুব প্রিয় কিন্তু আমাদের কথা ভেবে মা নিজের জীবনের সমস্ত শখ আহ্লাদ বাদ দিয়েছে।
আমরা দুইবোনই পড়াশোনায় ভালো। বাবা অনেক কষ্ট করে পরিশ্রম করে আমাদের পড়াশোনা করিয়েছেন।পড়াশোনা শেষে এখন আমরা দুবোন অনেক ভালো বেতনের চাকরি পেয়েছি।ঈদে মা'র জন্য দশ বারোটা করে নতুন শাড়ি কেনার ক্ষমতা এখন আমাদের হয়েছে। ছুটিতে আমি আর মিতু বাড়ি এসে দেখি মা সেই নীল শাড়ির কাঁথা গায়ে দিয়ে ঘুমাচ্ছে।
রাতে আমি ,বাবা আর মিতু আলোচনা করে ঠিক করলাম এবার ঈদে মা'কে অন্য রকম উপহার দেবো।ঈদের ছুটিতে দুই বোন বাড়ি এসেছি। বাবার সাথে চোখে চোখে কথা হলো, বাবা চোখ বন্ধ করে মাথা কাত করে জানালেন সব কিছু ঠিক আছে। দুই বোন মা'র গলা জড়িয়ে ধরে বললাম,মা আমাদের সাথে একজায়গায় চলো।
মা অবাক হয়ে বলল, এই মাত্র বাড়ি এসে আবার কোথায় যাবি?বলা যাবে না তুমি চলো, প্রাইভেট কারে করে যাচ্ছি।খানিক পরে মায়ের হাত ধরে গাড়ি থেকে নামিয়ে নিয়ে বললাম, সামনে তাকিয়ে দেখো মা, এইটা তোমার উপহার পছন্দ হয়েছে? মা অবাক হয়ে দেখছে, তার সামনে একটা শাড়ির দোকান আর দোকানের সাইনবোর্ডে তার নিজের নাম লেখা "কল্পনা শাড়ি বিপনি । মায়ের মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না কোনরকমে বলল, আমার নামে শাড়ির দোকান কিনেছিস শুধু তোমার নামে না এই শাড়ির দোকানটাই তোমার।তোমার যে শাড়িটা পছন্দ হবে সেটাই পরে বাবার সামনে দাঁড়াবে।
মা ফিতে কেটে দোকানে প্রবেশ করে খুশিতে বাচ্চা মেয়ের মতো একটা একটা করে শাড়ি বের করে পরম মমতায় হাত বুলিয়ে আবার রেখে দিচ্ছে।উপহার পছন্দ হয়েছে? বাবা এখন পরিশ্রম করতে পারে না সারাদিন ঘরে বসে থাকতে ভালো লাগবে না, মাঝে মাঝে দোকানে বসবে।দুই জন কর্মচারী আছে তারাই সব করবে। তুমিও বাবার সাথে মাঝে মাঝে দোকানে আসবে পছন্দ মতো শাড়ি নেবে।আমরা সবাই দোকানে বসে আছি, এক দু'জন করে ক্রেতা আসছে টুকটাক বিক্রি হচ্ছে , মা মুগ্ধ হয়ে দেখছে।
অল্প বয়সী শ্যামলা রঙের এক মহিলা চার পাঁচ বছরের মেয়ের হাত ধরে দোকানে ঢুকলো। দেখেই বোঝা যাচ্ছে মধ্যবিত্ত ঘরের বউ। শাড়ি দেখতে দেখতে একটা শাড়ি তার খুব পছন্দ হলো। দামাদামি করে শেষ দাম হলো দুইহাজার টাকা। মহিলা শাড়িটা সরিয়ে অন্য শাড়ি দেখছে কিন্তু ঘুরে ফিরে ঐ শাড়িটাই ধরছে। শেষে বললো পছন্দ হচ্ছে না বলেই উঠে চলে যাচ্ছে।
হঠাৎ মা বলল, একটু দাঁড়াও মেয়ে।ঐ শাড়িটা নিয়ে যাও।কিন্তু আন্টি আমার কাছে অতো টাকা নেই। তোমাকে কোনো টাকা দিতে হবে না ঐ শাড়িটা আমি তোমাকে ঈদে উপহার দিচ্ছি।মহিলা অবাক হয়ে মার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনার দেওয়া শাড়ি নেবো কেন।
মা হালকা হাসি দিয়ে বলল, আমার এই দুই মেয়ের মতো তুমি আমার আরেকটা মেয়ে তাই।বাবা বলে উঠলেন, মাগো উনি হচ্ছেন মায়াপরী, মায়াপরী ভালোবেসে যে উপহার দেয় নিতে হয়।মেয়েটি ছলছল চোখে বাবা-মা'কে সালাম করে শাড়ির বাক্স নিয়ে চলে গেল।মা করুণ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, এভাবে শাড়ি দিলাম বলে তুই কি রাগ করেছিস রিতু।
মা এইটা তোমার দোকান তোমার যা খুশি করতে পারো, তোমার আনন্দই আমাদের কাছে বড়ো।মা মিষ্টি হেসে বাবাকে বলল,আচ্ছা ঈদের দিন এই মেয়েটা যখন পছন্দের নতুন শাড়ি পরে ওর স্বামীর সামনে দাঁড়াবে তখন ওর স্বামী কি বলবে এইটা খুব জানতে ইচ্ছা করছে।শোনো মায়াপরী, স্বামী-স্ত্রীর ভিতর যদি সত্যিকারের ভালোবাসা থাকে তাহলে স্ত্রী যতোই দেখতে কুৎসিত হোক না কেন স্বামীর চোখে সে পরীর মতো সুন্দরী। এই মেয়ের স্বামী যদি সত্যি তার স্ত্রীকে ভালোবাসে তাহলে বলবে, ও আল্লাহ তোমাকে তো পরীর মতো সুন্দর লাগছে! আমি অনেক ভাগ্যবান তাই তোমার মতো পরীকে পাশে পেয়েছি।
বাবার কথা শুনে মা কেমন মিষ্টি মিষ্টি হাসছে।বাবা-মায়ের হাসিমুখ দেখতে দেখতে কেন জানি না আমার দু’চোখ পানিতে ভরে উঠল।অফিসে যাওয়ার আগ মুহুর্তে আমার স্ত্রী যখন আমার কাছে জানতে চাইলো আমি তার ছোট বোনের বিয়েতে কি উপহার দিবো তখন আমি বললাম তুমি তোমার পছন্দমতো কিছু একটা কিনে দিও।
আমার স্ত্রী কিছুটা রেগে বললো কিছু একটা কিনে দিবো মানে তুমি জানো দুলাভাই আমার বোনকে কি উপহার দিচ্ছে? হাজার টাকা দিয়ে সোনার কন্ঠ হার আমি বললাম তাহলে এখন আমার কি করতে হবে আমার স্ত্রী হেসে বললো,আমি আমার বোনকে ২লাখ টাকা দিয়ে সিতা হার কিনে দিবো।কথাটা শুনে আমি অবাক হয়ে বললাম যদি ২য় শ্রেণীর কর্মকর্তা হয়ে এতোটাকা দিয়ে উপহার দিতে পারে তাহলে তুমি ১ম শ্রেণীর কর্মকর্তা হয়ে কেন পারবে না? এখন তুমি যদি দুলাভাইয়ের চেয়েও কম দামের উপহার দাও তাহলে বাপের বাড়িতে আমি মুখ দেখাতে পারবো।
আমি কিছুটা বিরক্ত হয়ে বললাম ঠিক আছে। আফিস থেকে আসার পর তোমায় টাকা দিচ্ছি।অফিসে এসে রায়হান সাহেবের ফাইলটা ভালো করে দেখে বললাম আপনার তো দেখছি কাগজ পত্রের কিছুই ঠিক নেই। আমি এই প্রজেক্টে সাইন কিভাবে করি বলেন তো?রায়হান সাহেব মুচকি হেসে বললো একটু দেখেন না! আপনি এতো বড় অফিসার। কিছু তো ফাঁক ফোকর আছে সাইনটা করে দেওয়ার জন্য। একটা কমলের খোঁচার বিনিময়ে আপনিও না হয় লাখ তিনেক টাকা পেয়ে গেলেন।
আপনি তো দেখছি পাকা খেলোয়াড়। ঠিক আছে আমি ফাঁক ফোকর খুঁজে কাল সাইন করে দিবো।রায়হান সাহেব চলে গেলে আমি মনে মনে ভাবতে লাগলাম, যাক শ্যালিকাকে সিতা হার কিনে দেওয়ার টাকার ব্যবস্থা হয়ে গেলো। এমন সময় হাবীব নামের একজন কলিগ আমার রুমে আসলো। সে যখন বললো সে চাকরি থেকে রিজাইন নিতে চায় তখন আমি খুব অবাক হয়ে উনাকে বললাম।
হাবীব মুচকি হেসে বললো এই চাকরি করলে হয় আমাকে ঘুষ খেতে হবে, না হয় রাস্তায় মরে পড়ে থাকতে হবে। আমি অসৎও হতে পারবো না, আর রাস্তায় মরে পড়ে থাকতে চাই না। তাই চাকরিটা ছেড়ে দিচ্ছি। শুনে আমি কিছুটা খোঁচা দিয়ে হাবীবকে বললাম আমার জানা মতে আপনি আমাদের সেক্টরে সবচেয়ে বেশিই ঘুষ খান। সেই আপনি কবে থেকে সৎ হলেন।
যেদিন থেকে বুঝলাম আমার পাপের ফল আমার আপনজনরা ভোগ করছে। আমি প্রথম যেদিন ১০ হাজার টাকা ঘুষ খাই সেদিন বাসায় গিয়ে শুনি আমার ছেলেটার পা ভেঙে গেছে। বার যখন ৫ হাজার টাকা ঘুষ খাই তার কয়েকদিন পর জানতে পারি আমার স্ত্রীর জরায়ুতে টিউমার হয়েছে। আর ৩য় বার যখন ১লাখ টাকা ঘুষ খাই তখন গ্রামের বাড়ি থেকে ফোন আসে আমার মা মারা গেছে। তারপরই আমি বুঝতে পেরেছি আমার ভুলটা।
চলে যাবার আগ মুহুর্তে হাবীব আমার দিকে তাকিয়ে বললো আপনি অবৈধ ভাবে যদি ৫টাকা ইনকাম করেন উপরওয়ালা আপনার থেকে বৈধ ভাবে টাকা কিভাবে যে কেড়ে নিবে আপনি বুঝতেই পারবেন না।হাবীব চলে গেলে আমি ওর কথাগুলো একটু চিন্তা করলাম।
বাসায় আসার পর আমার স্ত্রী যখন আমার কাছে টাকা চাইলো আমি তখন ওর হাতে আমার বেতনের টাকাটা তুলে দিয়ে বললাম এইখানে ৪৫হাজার টাকা আছে। এই টাকা দিয়ে তুমি বাসা ভাড়া দিবে, গ্যাস বিল, পানির বিল, কারেন্ট বিল দিবে, বাজার খরচের টাকা আলাদা করে রাখবে , হাত খরচের টাকা আলাদা করে রাখবে। আর চিকিৎসা বাবদ কিছু টাকা জামা রাখবে। সব কিছুর পর যদি কিছু টাকা বেঁচে থাকে সেই টাকা দিয়ে বোনকে উপহার কিনে দিবে।আমার কথা শুনে আমার স্ত্রী অবাক হয়ে বললো সব কিছুর পর তো হাতে দুই হাজার টাকাও থাকবে না।
আমি দুই হাজার টাকা দিয়ে বোনকে উপহার কিনে দিবো আমি রাগী চোখে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললাম সংসারের সব খরচ চালানোর পর তোমার স্বামীর হাতে ২ হাজার টাকাও থাকে না আর তুমি কোন সাহসে বলো তোমার বোনকে দুইলাখ টাকা দিয়ে সোনার হার কিনে দিতে বউ তখন কাঁদতে কাঁদতে বললো বাপের বাড়ি মুখ দেখাবো কি করে।
-মুখ দেখাতে না পারলে বোরকা পড়ে বসে থেকো।এখন কান্না বন্ধ করে আপাতত আমার সামনে থেকে যাও তা নাহলে কান গরম করে ফেলবো।বউ কান্না করতে করতে চলে গেলো আর আমি ভাবতে লাগলাম কাল রায়হান সাহেব আসলে উনার কানটা গরম করে টাকাগুলো ফিরত দিতে হবে।