হাসপাতালের রুমে ঢুকেই মা বাবার গালে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিলো।ডাক্তার-নার্স এমনকি আমিও চমকে গেলাম। তুমি থাকতে চারু'র এ্যাকসিডেন্ট হলো কীভাবে আসলে টার্ন নিতে গিয়ে বাইক থেকে পরে গেছে আর আমিও বুঝতে পারিনি।তোমার মতো দায়িত্বহীন মানুষের কাছে চারুর দায়িত্ব দেওয়াটাই আমার ভুল হয়ে গেছে। তুমি নিজে ওকে আমার কাছে ফেলে রেখে চলে গেছ তোমার ক্যারিয়ার গড়তে।শোন আমার জন্যই সে আজ এত বড় স্কুলে পড়তে পারছে।তুমি পারতে ওত দামি স্কুল অ্যাফোর্ড করতে
এটা তোমার ধারনা। শিক্ষা দামি-কমদামি হয় না।সে একই জিনিস শিখত কিন্তু বাংলায়।তুমি তার পড়াশোনার দায়িত্ব নিতে চেয়েছো আমি না করিনি কারণ তুমি তার মা। কিন্তু আমাকে সবার সামনে কোন অধিকারে থাপ্পর মারলে কারণ আমি এখনো তোমার স্ত্রী, আমাদের এখনো ডিভোর্স হয়নি।ধন্যবাদ।ভুলে গিয়েছিলাম।এই নাও আরো মারো।বাবার এই কথা শুনে আমি হেসে ফেললাম।বাবাও আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। কিন্তু মা রাগে গজগজ করছে।মা বলল চারু,এখন থেকে তুই আমার সাথে থাকবি।এখনি আমার গাড়িতে করে তোর বাবার বাসায় গিয়ে তোর সব জিনিস নিয়ে আসবি।চল আমার সাথে।
আমি বাবার দিকে তাকালাম।বাবা হ্যাঁসূচক ঘাড় নাড়লেন।আমিও খুশি হয়ে গেলাম খুব।মা বিশাল বড় একটা অ্যাপার্টমেন্টে থাকেন। সম্পূর্ণ তার নিজের।আর খাবার তো চাইনিজ-ইতালিয়ান ছাড়া কথাই নেই। খুব মজা হবে সেখানে। কিন্তু বাবার জন্যও খারাপ লাগছে, বাসায় একা কী করে থাকবে।সে যাই হোক।আমি আমার সব জিনিস নিয়ে মায়ের সেই বিশাল বড় বাড়িতে চলে আসলাম।আমাকে একটা বিশাল বড় রুম দিল।আমার খুব ভালো লাগছে।পরের দিন সকালে দেখি মা অফিসের জন্য বের হয়ে যাচ্ছে,আমাকে বলল চারু,ফ্রিজে ব্রেড আর জ্যাম আছে খেয়ে নিস।আর এই নে,এই টাকা দিয়ে দুপুরে তোর যা ভালো লাগে খেয়ে নিস।আমি গেলাম।
ব্রেড আর জ্যাম!এর থেকে তো বাবার হাতের লুচি অনেক ভালো আছে। কিন্তু মা আমাকে একবেলা খাওয়ার জন্য পাঁচশ টাকা দিয়ে গেল ভাবতেই কেমন মজা লাগছে।অনেক রাতে মা বাসায় ফিরলো।মাকে বললাম ক্ষুধা পেয়েছে।মা বলল।
তো?আমি এখন রান্না করব নাকি!দেখ এমনিতেই অনেক ক্লান্ত আর বেশি বকিস না।আমি না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়লাম।মা কিছু বললও না।অথচ বাবা কখনো আমাকে না খেয়ে ঘুমোতে দেয়না।সকালে আবার সেই জ্যাম-পাউরুটি।মা আমার হাতে টাকা দিয়ে চলে গেলেন।আমি স্কুলের টিফিন টাইমে চলে গেলাম বাবার অফিসে। কিছু কথাবার্তা বললাম,কেমন আছি না আছি এরপর।
সেখানে বাবার সাথে খাওয়া করে আমি আবার স্কুলে ফিরে গেলাম। বিকালে বাসায় ফিরতেই দেখি মা আমার উপর খুব রেগে আছে। চারু তুই আমাকে না বলে তোর বাবার অফিসে গিয়েছিলি।
হ্যাঁ কিন্তু এতে রাগার কী আছে?বাবা তো কখনো আমাকে তোমার সাথে দেখা করতে বাধা দেয় নি। এরপর থেকে গেলে আমার অনুমতি নিয়ে মেতে হবে।
পরেরদিন আমি আবার গেলাম বাবার অফিসে।চলে আসার সময় বাবা মায়ের জন্য একটা টিফিন বক্স দিয়ে বললোএটা তোর মায়ের জন্য বকা দেয় যদি আরেহ দিবেনা।তুই শুধু বলবি বাবা দিয়েছে বিকেলে মা আসলে মাকে বললাম তোমার জন্য বাবা কিছু দিয়ে পাঠিয়েছে।
আমি টিফিন বক্সটি নিয়ে আসলাম।মা খুলে দেখে মায়ের সব প্রিয় খাবার।মা কিছু না বলে একটি প্লেট নিয়ে চুপচাপ খাওয়া শুরু করলো।খেতে খেতে মা যেন কোথায় হারিয়ে গেল,মনে মনে হাসতে লাগলো।আমি জিজ্ঞেস করলাম কেন হাসছে।
তোর বাবার কিছু মজার ঘটনা মনে পড়ল মিস করো বাবাকে হূমকরি তো তাহলে আলাদা থাকো কেন শোন কোন সম্পর্কে তিক্ততা আসার আগেই ভালো ভাবে সড়ে আসা ভালো।তার স্বপ্ন আর আমার স্বপ্ন অনেক আলাদা,মতের অনেক অমিল। দুজনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিয়েই আমরা আলাদা থাকছি।
কখনো ইচ্ছা করে না সবাই একসাথে থাকার হয়তো করে পরেরদিন বিকেলে আমি গিটার নিয়ে প্র্যাকটিস করছি মা এসে বলল তুই এভাবে এখানে গান বাজাতে পারিস না।এই সোসাইটি তে আমার একটা ইমেজ আছে।আর এসব বাদ দিয়ে পড়াশোনা কর তাহলে আমার মত কিছু হতে পারবি।এসব আমার বাসায় চলবে না।
-কই বাবা তো কখনো আমাকে গান গাওয়া থেকে আটকায়নি।আর তোমার সোসাইটি যেখানে কোনো স্বাধীনতা নেই।আর যাই হোক মা,বড় হয়ে আমি তোমার মতো হতে চাই না। একটি বাড়ি,গাড়ি আর ব্যাংকে কিছু টাকা ছাড়া কী আছে তোমার কাছে থাকতে চাই না তোমার সাথে। আমার সাদামাটা বাবার সেই ছোট্ট বাড়িই আমার জন্যে ঠিক আছে।আমি যাচ্ছি মা।যদি কখনো ইচ্ছে হয় একসাথে থাকার চলে এসো।
আমি বাসায় চলে আসলাম।দেখি বাবা আমায় দেখে হাসছে। কীরে থাকতে পারলি না তো ওর সাথে।এত তাড়াতাড়ি চলে এলি। আমার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। বাবাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলাম। বাবা বলল।
আরে আমার চারু!কাঁদছিস কেন? মায়ের কথা মনে পড়লে চলে যাবি দেখা করতে।আমি তো আর আটকাই না তাই না।
আমি কাঁদতেই আছি। এমন সময় দরজায় কড়া নাড়ছে কে যেন।বাবা দরজা খুলে থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।মা এসেছে।কোনো কথা না বলেই ভিতরে ঢুকে পড়লো।বলল।
বাবা মায়ের জন্য খাবার নিয়ে আসতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।আমি অবাক হয়ে তাদেরকে দেখছি।মা নিজ হাতে আমাকে খাইয়ে দিলো।মা সেদিন যে এলো আর যায়নি।থেকেই গেলো আমাদের সাথে,তার নিজের সেই।
সন্ধ্যার মুখে মুখে মায়ের একটি কথায় বাপ্পির পুরো পৃথিবীটা উল্টে পাল্টে গেল। মা তাকে তার প্রিয় পোষা মুরগি টি ধরে বুয়াকে দিতে বললেন জবাই করবার জন্য। হঠাৎ করে তার ভাইটি এসে হাজির হয়েছে ময়মনসিংহ থেকে। ঘরে কোন আনাজপাতি নেই। বাজার যাবো যাবো করে কেন যেন যাওয়া হয়নি বেশ অনেকদিন। তার এই ভাইটি হঠাৎ হঠাৎ মাঝ রাতে এসে হাজির হয়। তার খুবই বুয়েটে পড়ার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সে বুয়েটে সুযোগ পায়নি। তার স্থান হয়েছে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। ব্রহ্মপুত্র পারের এই শহরটিকে তার নির্বাসন এর মত লাগে।
সুযোগ পেলেই সে ঢাকা চলে আসে।তার মনের গোপন ইচ্ছা আবারো পরীক্ষা দিয়ে সে একসময় ঠিকই বুয়েটে ভর্তি হবে।যে সময়ের কথা বলছি তখন বুয়েট কিংবা ঢাকা মেডিকেল ছাড়া অন্য কোন পড়ালেখাকেই ভালো ছাত্ররা পড়ালেখা বলে মনে করত না। এ দুটোর একটা তো সুযোগ না হোলে মনে করত তাদের জীবনটাই বৃথা।
এমনিতে বাপ্পির এই ভাইটি তার খুবই প্রিয়। কিন্তু আজকে তার ভাইটিকে অসহ্য মনে হচ্ছে। সে ঢাকা আসলে একটি গান বাজায়। এটি হচ্ছে তার সিগনেচার মুভ ।এই গানটি বাজালেই আশে পাশের বাসার সবাই জানে সে ঢাকায় এসেছে।গানটি হচ্ছে আর ডি বর্মনের মেহবুবা। অন্য সময় গানটি তার খুবই ভালো লাগে। কিন্তু আজকে অসহ্য লাগছে। পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে একই জিনিস ভিন্ন সময়ে ভিন্ন প্রভাব ফেলে আমাদের মন।
বাপ্পি একটা জিনিস লক্ষ্য করে দেখেছে,তার এই ছোট্ট বছরের জীবনে সব বড় ঘটনাগুলিই ঘটে সন্ধ্যার মুখে মুখে। আজও এর ব্যতিক্রম হলো না। মা যখন মুরগিটা ধরে মাজেদার মা বুয়াকে দিতে বললো জবাই করবার জন্য, তখন সে নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। মা কি জানেনা এই মুরগিটা তার কত প্রিয়। তারপরও এমন একটা কথা সে কি ভাবে বলল। রাগে দুঃখে তার দুই চোখ ফেটে পানি বেরিয়ে আসল। তবুও সে মাকে অভিমানে কিছুই বলল না।
আপনাদের একটা গোপন কথা বলি। হাতের পাঁচটা আঙুল যেমন সমান হয় না তেমনি বাবা মায়ের ভালোবাসার মধ্যেও বৈষম্য থাকে। না হলে বাপ্পির মা কখনোই বাপ্পী কে তার প্রিয় মুরগিটিকে ধরতে বলতে পারতো না। এই ছোট্ট ঘটনা বাপ্পির মনে কী প্রভাব ফেলবে তা উনি একবার চিন্তাও করলেন না। তার মনে শুধু একটা ভাবনাই কাজ করেছে। ছেলেটা হোস্টেলে ভালো মন্দ কিছু খেতে পারে না। হঠাৎ করে এসে পড়েছে। তাকে ছোট ছেলের পোষা মুরগির রান দিয়ে ই আজ ভাত খাওয়ানো হবে। তার ছেলে যে মুরগির রান কতটা পছন্দ করে তা কি তিনি আর জানেন না? মাংস শেষ হয়ে গেলে হাড় চিরে ভিতরের খয়রি অংশগুলো পর্যন্ত খুঁটে খুঁটে খায়। দেখে এত মায়া লাগে।
ইতিহাসে একই ঘটনা ঘুরেফিরে বারবার ঘটে। বাপ্পির মা তার কোন একটি সন্তানের জন্য এই যে প্রথম বাপ্পির মনে আঘাত দিচ্ছেন তা কিন্তু না। এর আগেও তিনি এই কাজ করেছেন। বাপ্পির যেমন একটি বড় ভাই আছে তেমনি একটি বড় বোনও আছে । বয়সে তার দুটো ছেলেমেয়ে পিঠাপিঠি। তিনি ভেবেছিলেন ছেলে মেয়ের ব্যাপারে তিনি হাত ধুয়ে ফেলেছেন। কিন্তু কোথা থেকে প্রায় ১০ বছর পরে অপরিকল্পিতভাবে তার এই ছোট ছেলেটির জন্ম হলো। ছেলেটি দেখতেও যে খুব একটা সুন্দর হয়েছে তাও না, কেমন যেন কাল হয়েছে দেখতে। তার অন্য ছেলেটির মত না। তার মেয়েও অবশ্য কাল হয়েছে। কদিন আগে তার মেয়ের বিয়ের কথা হচ্ছিল। পাত্র পক্ষের মেয়ে দেখতে আসার কথা ছিল সন্ধ্যার পর পর। তিনি তার ছেলেকে ডেকে বললেন সে যেনো দরজা খুলতে না যায় কেউ ধাক্কা দিলে। তিনি চাচ্ছিলেন না তার এই কাল ছেলেটিকে দেখে পাত্রপক্ষ যেন হঠাৎ ভরকে না যায়। তারা যেন না ভাবে ভাই এতো কাল বোন না যেন আরো কত কালো হবে।
কাজটা তিনি খারাপ করেছিলেন নিঃসন্দেহে, তবে তার চাইতেও যে খারাপ কাজ করলেন তা হল, বাপ্পি যখন জিজ্ঞেস করল কেন সে দরজা খুলতে পারবে না, তখন তিনি অন্য কিছু ব্যাখ্যা দিতে পারতেন। তিনি সে ঝামেলায় গেলেন না, বাপ্পি কে সত্যি কথাটাই বললেন। একবারও ভাবলেন না বছরের শিশুর উপর এর প্রভাব কি হবে। এটা একটা পরীক্ষিত সত্য যে এই পৃথিবীতে যারা সুশ্রী তারা কুৎসিত মানুষের থেকে সচরাচর বেশি সফল হয়।' পহেলা দর্শন ভারী' বলে যে প্রবাদটি প্রচলিত রয়েছে, সেটা একেবারে মিথ্যা নয়। আমরা এক পর্যায়ে গুন ঠিকই বিচার করি, তবে প্রথমে দর্শনে আমাদের অনুভূতি বিচার করবার পর। আমাদের জীবন আসলে অনেকটা তাস খেলার মতন।যে লোকটা বাটে সে যেমন আপনার হাতে কিছু তাস দিয়ে দেয়, আপনাকে যেমন হঠাৎ ভাগ্যে পাওয়া তাস গুলোকে উল্টোপাল্টা করেই খেলাটা চালিয়ে যেতে হয় আমাদের জীবনও কিন্তু তেমনি ভাগ্য নির্ভর। যে ধরনের বাহ্যিক সৌন্দর্য এবং মেধা নিয়ে আমরা পৃথিবীতে আসি, সেটাকে ব্যবহার করেই কিন্তু আমাদের সফলতা আনতে হয় জীবনে।প্রকৃতি প্রদত্ত এই দান আমরা কিভাবে ব্যবহার করব তার উপরই আমাদের জীবন নির্ভর করে।
বাপ্পি সচরাচর সন্ধ্যার মুখে মুখে মুরগিটিকে ধরে তার তার চৌকির পায়াটার সাথে বেঁধে রাখে। প্রতি সন্ধ্যায় একই রুটিন, তাই বাপ্পি যখন মুরগিটিকে ধরতে ধেয়ে এল, তখন মুরগিটি নিজেকে বাঁচানোর কোনো চেষ্টা করল না, খুব সহজেই ধরা দিল বাপ্পির হাতে। কিন্তু মুরগির লাল পুতির মতোন চোখগুলো দিকে তাকিয়ে দুঃখে বাপির বুকটা ভেঙে গেল। এক সময় সে আর তার ভাই চৌকিটাতে ঘুমাতো।
তার ভাই ময়মনসিংহে চলে যাবার পর থেকে বাপিকে একাই ঘুমাতে হয়। ওর জানালার পাশে রয়েছে একটি সুপারি গাছ। মাঝে মাঝে রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের সোডিয়ামের মরা আলো সেই সুপারি গাছটার উপর পড়ে বাপ্পির ঘরের অন্ধকারাচ্ছন্ন দেয়ালে অদ্ভুত ভয়ঙ্কর সব ছায়ার নকশা তৈরি করতো।
ভাই চলে যাওয়ার পরে প্রথম দিকে কোন কোন রাতে ভয়ে বাপির ঘুম আসত না। কি করে যেন মুরগিটা সে ব্যাপারটা টের পেত। চৌকির নীচ থেকে কক কক করে উঠত, যেন সে বাপ্পী কে অভয় দিত,অবুঝ প্রাণীদের অবোধ ভাষায় যেন সে বলতো ,"তুমি আরাম করে ঘুমাও, আমি আছি!তোমার ভাই তোমাকে ফেলে চলে গেছে ,কিন্তু আমি তোমায় ছেড়ে কোথাও যাবো না।
অসংখ্য ভয়ের রাতে যে তার সঙ্গী ছিল, আজকে তার সেই বন্ধুর ঋণ শোধ করবে তাকে মাজেদার মায়ের হাতে তুলে দিয়ে, এত অকৃতজ্ঞ বাপ্পি না। মুরগি টির সাথে তার কত অসংখ্য স্মৃতি। এক ছুটির সকালের কথা।হঠাৎ করে দেখে পাশের বাসার মোরগটা তার মুরগিকে তাড়া করছে। একসময় সে মুরগিটি কে ধরে ফেলল তারপর মুরগিটির উপরে উঠে তার টুটি চেপে ধরল। এই দৃশ্য সহ্য করা কঠিন। বাপ্পি তার ক্রিকেট ব্যাট দিয়ে মোরগটির দিকে ধেয়ে গেল একটা বাড়ি দেবে বলে। সাথে সাথে কানে এলো মাজেদার মা বুয়ার চিৎকার।
ব্যাপারটা বাপ্পির ঠিক বিশ্বাস হয়না।সে টিভিতে বাংলা সিনেমায় রাজ্জাক কবরী কে ভাব ভালোবাসা করতে দেখেছে। রাজ্জাক কবরী কে জড়িয়ে ধরে ওর পিঠের মধ্যে হাত বোলাতে থাকে, কিন্তু এভাবে টুটিতো চেপে ধরে না।তবে সে মাজেদার মার কথা ঠিক অবিশ্বাস ও করতে পারে না,কারণ এই জীবনে তার যতো জ্ঞান তার একটা বড় অংশ সে শিখেছে মাজেদার মার কাছ থেকে। আর তাই যখন মাজেদার।
বাপ্পি তার এ কথাটি ও বিশ্বাস করলো।কারণ এ পর্যন্ত মাজেদার মা তার সাথে কখনোই মিথ্যা কথা বলে নাই।তার কিছুদিন পর সত্যি সত্যি সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এসে উপস্থিত হলো।মুরগিটি চৌকির নীচে বসে অপেক্ষা করতে থাকলো ডিম পাড়ার। বাপ্পির ও মনে গোপন ইচ্ছা সে চৌকিতে বসে মুরগির সাথে অপেক্ষা করবে। কিন্তু তাকে স্কুল যেতে হবে। সে ভেবে ভেবে একটা বুদ্ধি বের করলো। তাদের বাড়ির পিছনে যে এক চিলতে জমি পড়ে রয়েছে, সেখানে সে বগলের নিচে একটু রসুন ভরে রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকলো বেশ অনেকক্ষণ।একসময় রোদের কারণে তার শরীর উত্তপ্ত হয়ে উঠল।সে মাকে গিয়ে বললো ,আজ স্কুল যাবে না ,তার জ্বর এসেছে। মা কপালে হাত দিয়ে দেখেন সত্যি গায়ে জ্বর। তিনি ছেলেকে চৌকিতে শুইয়ে দিয়ে গেলেন।
হিলারি যখন হিমালয় পর্বতের চূড়ায় উঠেছিলেন তিনি কতটুক আস্ফালন করেছিলেন আমি জানিনা, তবে ডিম পাড়ার পরপর মুরগিটি যে আচরণ করল তার সাথে বাপ্পি মোটেই পরিচিত ছিল না।এত জোরে ডাকতে শুরু করলো যেন সে বিশাল কিছু করে ফেলেছে। এই পৃথিবীতে অবিমিশ্র আনন্দ বলে আসলে কিছু নেই।কারণ এই ঘটনার কিছুক্ষণের মধ্যেই একটি ভয়ানক অন্যায় করা হয় মুরগিটির সাথে। মাজেদার মা বুয়া বাপ্পির মায়ের নির্দেশে ডিম নিয়ে যেয়ে পোচ করে তার বোনের নাস্তার জন্য। তার বোন বদরুন্নেসা কলেজে পড়ে। প্রতিদিন সকালে কলেজ যাওয়ার আগে একটি ডিম আর একটি আটার পরোটা তার সকালের নাস্তা।সচরাচর রাস্তার উল্টাদিক এর আবুলের দোকান থেকে এই ডিমটা সরবরাহ করা হয়।
তবে মুরগিটির কারনে আজ ডিমের পয়সা বেঁচে গেল।মুরগিটি যথাসময়ে ডিমে তা দিতে এসে দেখে সেখানে কোনো ডিম নেই। সারা বছর সন্তান ধারণ করে শেষ মুহূর্তে মৃত সন্তান প্রসব করলে মায়েদের যে ধরনের কষ্ট হয়, মুরগি টিরও নিশ্চয়ই সে ধরনের কষ্টই হয়েছিল। কিন্তু যেহেতু সে আমাদের ভাষায় কথা বলতে পারে না তাই হয়তো কোনো অভিযোগ করতে পারেনি, নিয়তিকে মেনে নিয়েছিল।
এই পৃথিবীতে হঠাৎ করে আসলে কিছু হয় না। যে একজন ভয়ঙ্কর খুনি হবে, সে প্রথমে কিন্তু মানুষ খুন করে না। প্রথমে সে প্রতিবেশীর কুকুর-বেড়াল এই ধরনের পোষা প্রাণী মেরে হাত পাকায়। বাপ্পির মা যখন মেয়ের নাস্তার জন্য মুরগির পাড়া প্রথম ডিমটি নিয়ে গেলেন, তখনই বাপ্পির প্রতিবাদ করা উচিত ছিল। তাহলে তিনি আজকে ছেলের জন্য পুরো মুরগিটি চাইতেন না। তবে ইংরেজীতে একটা কথা আছে, বেটার লেট দ্যান নেভার।বাপ্পি ঠিক করলো সে তার মুরগিটা মাজেদার মাকে দেবে না। সে মুরগিটি কে নিয়ে দৌড়াতে শুরু করলো।
প্পিরা থাকে গোপীবাগে, আর কে মিশন রোডে।সে যখন দৌড়াতে দৌড়াতে অভয় দাস লেন পার হয়ে , জর্জ গলি পার হয়ে, গোপীবাগ থার্ড লেনে এসে পৌঁছল তখন এশার আযান ভেসে আসতে শুরু করেছে মসজিদ গুলো থেকে। তার গন্তব্য বালুর মাঠ। প্রতিদিন বিকেলে এখানেই সে খেলতে আসে। মাঠটি বিশাল।রাতের অন্ধকারে তার কাছে একেবারে তেপান্তরের মাঠের মতো মনে হলো। সে কোন দিকে যাবে ঠিক করতে পারছিল না।
ঘটনা যার জন্য ঘটলো, বাপ্পির সেই ভাই অবশ্য এসবের কিছুই জানলেন না।যদিও তিনি একঘেঁয়েমি কাটাতে প্রায়ই ঢাকায় চলে আসেন,তবে তার এবারে ঢাকা আসার পিছনে একটি বিশেষ কারণ রয়েছে। তার ধৈর্য রবার্ট ব্রুস এর কাছাকাছি। তিনি তৃতীয়বারের মতো বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে ঢাকা এসেছেন। যেহেতু আমরা ভবিষ্যৎ দেখতে পাই না, তাই তিনি জানেন না যে তার এ বারে চেষ্টা ফলপ্রসূ হবে।
তিনি কাল সকালে অনুষ্ঠিতব্য ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবেন। তার জীবনের একমাত্র আশা পূরণ হবে। আজ থেকে বছর চারেক পরে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি থেকে তিনি একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে বের হয়ে আসবেন এবং বাংলাদেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা তার হাতে তৈরি হবে,যার মাঝে ভৈরবের ব্রিজ কিংবা পান্থপথ অন্যতম।